এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ দেশটির একাধিক রাজ্য। প্রতিবাদ জানাতে বুধবার রাতে লাখ লাখ নারী, পুরুষ ও ছাত্র রাস্তায় নেমে আসেন। কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। কলকাতার পাশাপাশি বারানসি, দিল্লি ও অন্যান্য শহরেও বিক্ষোভ হয়।
ওই নারী ডাক্তারের হত্যার দ্রুত তদন্ত ও বিচারের দাবিতে ‘রাতের দখল নাও’ কর্মসূচি পালন করেন নারীরা। এই কর্মসূচির আওতায় রাত ১২টার আগেই বহু মানুষ কলকাতার রাস্তায় নেমে আসেন। বুধবারের ওই প্রতিবাদ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যাণার্জী বলেন, এই আন্দোলনের আড়ালে বিরোধী দলগুলো আমাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাচ্ছে। খবর আনন্দবাজার ও অন্যান্য ওয়েবসাইটের।
খবরে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা এক পর্যায়ে আর জি কর হাসপাতালে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। নিহত ওই চিকিৎসকের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার সোদপুরে। তার মা-বাবা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালে তাদের মেয়ের ডিউটি ছিল।
দিবাগত রাত দুটায় নৈশভোজ সেরে জরুরি বিভাগের চারতলায় একটি সম্মেলনকক্ষে বিশ্রাম নিতে যান। এরপর শুক্রবার সকালে সেখানে তার মরদেহ পাওয়া যায়। এই ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে রাস্তার বিক্ষোভে রাত ১১টা ৫৫ মিনিট থেকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শুরু হয়; যা কলকাতার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাসহ অন্যান্য ছোট ও বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ‘আমরা বিচার চাই’ ও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের দাবিতে শহর প্রকম্পিত করে তোলেন। এসব বিক্ষোভে রাজনৈতিক দলের পতাকা প্রদর্শন আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
আরো পড়ুন - আফ্রিকার পর সুইডেনে ছড়িয়ে পড়েছে মাঙ্কিপক্স
বিক্ষোভকারীদের একজন রিমঝিম সিনহা এই ঘটনাটিকে নারীদের জন্য ‘নতুন স্বাধীনতা সংগ্রাম’ হিসেবে বর্ণনা করেন। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস এবং যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ডে প্রাথমিক জমায়েতের পরিকল্পনা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে প্রতিবাদ আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহর ও জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। নিউ টাউনের বিশ্ব বাংলা গেটে বুধবার রাতে প্রায় আট হাজার মানুষ মোমবাতি ও মর্মস্পর্শী বার্তা সংবলিত পোস্টার হাতে আলোর সমুদ্র তৈরি করেন। যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড থেকে কলেজ স্কয়ার, নাকতলা নবপল্লী থেকে নিউ টাউন ও বিশ্ব বাংলা গেট, বেহালা শাখের বাজার থেকে শ্যামবাজার ফাইভ পয়েন্ট ক্রসিং, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে নাগেরবাজার পর্যন্ত বিক্ষোভরত মানুষের ভিড় চোখে পড়ে। একই দৃশ্য দেখা যায়, শ্রীরামপুর, চুনচুড়া, শান্তিনিকেতন, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান, ডায়মন্ড হারবার, শিলিগুড়ি, বারাসত, ব্যারাকপুর, রাজারহাট-নিউটাউন, কোচবিহার ও জলপাইগুড়িতেও। শিয়ালদহ স্টেশনে প্রতিবাদে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে। সেখানকার ফুটপাতবাসীরা তাতে শামিল হন। কিছু নারী প্রতিরোধের শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে শাঁখ বাজান। ডায়মন্ড হারবারে হাজার হাজার নারী মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আগুনের পরশমণি’ গেয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে প্রবীণ একজন নারী স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তার মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘ওই নারী চিকিৎসকের ওপর ভয়াবহ হামলার খবর শুনে আমি ঘুমাতে পারিনি। আমার মেয়ে প্রায় একই বয়সের এবং পুনেতে কাজ করে। আমি প্রতিদিন তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এই আন্দোলনের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এটা দুঃখজনক যে আমরা এখনো এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি। এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য আমাদের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বুধবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় মমতা বলেন, সিপিআইএম ও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে এই বিক্ষোভ করছে। তিনি বাংলার অপমান করার জন্য বিরোধীদলের সমালোচনা করেন। মমতা বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে বিজেপি ও সিপিআইএম পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাকে অবমাননা করার সমন্বিত উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে কলকাতা হাইকোর্ট এই মামলার তদন্তভার কলকাতা পুলিশ থেকে গোয়েন্দা বিভাগ সিবিআইর কাছে হস্তান্তর করেছে।
এ পরিস্থিতিতে মমতা কর্মবিরতিতে থাকা চিকিৎসকদের কাজে ফেরার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের এখন কাজে ফিরে আসতে হবে। আমার সরকার সিবিআইকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। আমরাও চাই এ বিষয়টির দ্রুত সুরাহা হোক। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী আরও দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গে এক ধরনের ‘অশুভ প্রচার চলছে। চলমান পরিস্থিতিতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় রাজ্য সরকারগুলোকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বুহস্পতিবার ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে মোদি বলেন, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও মহাকাশ খাত সহ বিভিন্ন খাতে ভারতীয় নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাশাপাশি কিছু উদ্বেগজনক ঘটনাও বাড়ছে। আমি আজ লাল কেল্লা থেকে আমার বেদনা প্রকাশ করতে চাচ্ছি। একটি (ঐক্যবদ্ধ) সমাজ হিসেবে আমাদের এ বিষয়গুলোকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে’, যোগ করেন মোদি। তিনি বলেন, আমাদের মা-বোনদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার ঘটনাগুলো নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আমিও সেই ক্ষোভের আঁচ টের পাচ্ছি। দেশকে, সমাজকে এবং আমাদের রাজ্য সরকারগুলোকে এসব ঘটনা প্রতি আরও গুরুত্ব দিতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে তদন্ত শেষ করতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ